বার্ধক্য? সে অনেক আগেই হাঁটু গেড়ে হার মেনেছে আরনল্ড শোয়ার্জেনেগারের
কাছে। তাই আঙুলের কর ধরে তাঁর বয়সের হিসাব করা যেন এক ব্যর্থ চেষ্টা। তবে
হ্যাঁ, প্রকাণ্ড দেহী ৬৮ বছরের এক পরিণত তরুণের কথা যদি জানতে চাওয়া হয়,
তাহলে সেখানে আরনল্ড শোয়ার্জেনেগারের নাম আসবে নিঃসন্দেহে। গত ৩০ জুলাই ছিল
তাঁর জন্মদিন। বয়স তাঁর এক বছর বেড়ে গেল—এমনটা বললে ভুল হবে। বলতে হবে,
‘আরও একটি বছর হেরে গেল আর্নির কাছে। ৬৭-ও বুড়ো বানাতে পারল না আর্নিকে।
তাই সেই তরুণ আর্নিকে নিয়েই এবারের আয়োজন।
বাবা গুস্তাভের কড়া শাসন সব সময়েই জারি থাকত ছোট্ট আর্নির ওপর। কারণ তিনি চাইতেন ছেলে বড় হয়ে তাঁরই মতো একজন পুলিশ কর্মকর্তা হবেন। কিন্তু দস্যি আর্নির স্বপ্নটা অনেক বড়। বিশ্ববাসীর আইকনে পরিণত হতে চান তিনি, সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির মতো পৃথিবী শাসন করতে চান। তাই তো ১৫ বছর বয়সে যখন তাঁর সমবয়সীরা আকাশকুসুম কল্পনায় বিভোর, তাঁদের অলস সময়টা কাটত প্রেম নিয়ে ভেবে; তখন আর্নি হাতে তুলে নেয় বারবেল আর ডামবেল। সেই যে অস্ট্রিয়ার থাল নামের ছোট্ট গ্রামে, বিশ্ব আইকনে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল আর্নি, সেটা বাস্তবে পরিণত হয় হলিউডের সুপারস্টার হয়ে আর ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নরের হওয়ার মধ্য দিয়ে।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে ৭৫ কেজি ওজনের এক দানবে পরিণত হন আর্নি। তত দিনে ছোটখাটো বিভিন্ন বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতায় সেরা হয়ে, অস্ট্রিয়াজুড়ে তাঁর পরিচিতি ছড়িয়েছে আরনল্ড অ্যালিওস শোয়ার্জেনেগার নামে।
১৯৬৫ সালে অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন শোয়ার্জেনেগার। চাকরি করার সময় থেকেই শরীরগঠন তাঁর কাছে পরিণত হয় ধ্যান-জ্ঞানে। যুদ্ধের ট্যাংকের পেছনে সব সময় রাখতেন বারবেল-ডামবেল। সুযোগ মিললেই শুরু হয়ে যেত ব্যায়াম। সেনাবাহিনীতে কর্মকর্তাদের বিনা অনুমতিতে শরীরগঠন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ইউরোপে যান শোয়ার্জেনেগার। ফলে তাঁকে এক সপ্তাহ কারাগারে বন্দী থাকতে হয়। তবুও দমে যাননি তিনি। ফল মিলল হাতেনাতেই।
১৯৬৭ সালে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে মাত্র ২০ বছর বয়সে ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ খেতাব জেতেন শোয়ার্জেনেগার। পরিচিতি পান আরনল্ড শোয়ার্জেনেগার নামে। এরপর ‘মিস্টার অলিম্পিয়া’ খেতাব জেতেন সাতবার।
তত দিনে যুক্তরাষ্ট্র দেশটা মনে ধরেছে শোয়াের্জনেগারের। নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পাড়ি জমান স্বপ্নের দেশে। হারকিউলিস ইন টাউন ছবি দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেও শোয়ার্জেনেগার আলোচনায় আসেন কোন্যান দ্য বারবারিয়ান ছবির মাধ্যমে। ১৯৮২ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। বিশ্ববাসী দেখেছে বিশাল দেহের এক রূপকথার নায়ককে। তাঁর ২৭ ইঞ্চির চওড়া বাহু মনে করিয়ে দেয় ওক গাছের কাণ্ডের কথা। ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতি যেন প্রকাণ্ড পাথরের চাঁই। কাঁধ বেয়ে নেমে আসা ঝাঁকড়া চুল আর খোলা শরীর নিয়ে সাগরপাড়ে তলোয়ারবাজির সেই দৃশ্য রাতারাতি পরিণত হয় পৌরুষের আইকনে।
তবে ইতিহাস সৃষ্টি করেন ১৯৮৪ সালে। জেমস ক্যামেরনের সাই-ফাই ছবি টার্মিনেটর-এ অভিনয় করলেন এক খুনে রোবটের চরিত্রে। বিশ্ববাসী দেখেছে কালো জ্যাকেট গায়ে আর চওড়া সানগ্লাস চোখে শোয়ার্জেনেগার বলছেন, ‘আই উইল বি ব্যাক।’ এরপরই পাল্টে যায় অ্যাকশন ছবির সংজ্ঞা। ওই বছর বক্স অফিস কাঁপিয়ে মাস্টারপিসে পরিণত হয় টার্মিনেটর। শোয়ার্জেনেগার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘অ্যাকশন হিরো’র তকমা।
কখনো কমান্ডোতে মেয়ে রক্ষায় তৎপর বাবার চরিত্রে, কখনো বা ইরেজার-এ ইউএস মার্শাল চরিত্রে তুলে নিয়েছেন অস্ত্র। ট্রু লাইজ আর কল্যাট্যরাল ড্যামেজ ছবিতে লড়েছেন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। পর্দা কাঁপিয়েছেন অসংখ্য অ্যাকশন ধাঁচের ছবিতে। অভিনয় করেছেন জুনিয়র আর কিন্ডারগার্টেন কপ ছবিতে অন্য রকম চরিত্রেও।
অভিনয়ের পাশাপাশি করেছেন মডেলিং। চওড়া কাঁধ আর দানবীয় শরীর হয়ে ওঠে পুরুষদের অনুকরণীয় আর নারীদের পরম আরাধনায়। টোটাল রিকল ছবিতে বিশ্বের অন্যতম আবেদনময়ী অভিনেত্রী শ্যারন স্টোনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করে কড়া জবাব ছুড়ে দেন সমালোচকদের মুখের ওপর।
হলিউডে সফল হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলেও ক্ষমতাসীন ব্যক্তির আসনটি তখনো দখলে নেওয়া হয়নি শোয়ার্জেনেগারের। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ সিনিয়রের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হওয়ার মাধ্যমে রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। ২০০৩ সালে গ্রে ডেভিসকে হারিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর নির্বাচিত হন রিপাবলিকান আরনল্ড শোয়ার্জেনেগার। জনপ্রিয়তার দৌড়ে ২০০৬ সালে আবারও সহজেই হারিয়ে দেন ডেমোক্র্যাট ফিল অ্যানজেলিডেসকে। অল্পের জন্য ছিটকে পড়েন প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড় থেকে। কিন্তু হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে হলিউড আর মার্কিন রাজনীতিতে প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন শোয়ার্জেনেগার। ষাটোর্ধ্ব বয়েস এসে এখনো এক্সপেন্ডেবলেস আর টার্মিনেটর জেনেসিস-এর মতো মারদাঙ্গা ছবি করে লজ্জা দিচ্ছেন হাঁটুর বয়সী নায়কদের।
সম্প্রতি এক তথ্যচিত্রে পরোক্ষভাবে নিজেই নিজেকে কিংবদন্তি দাবি করেন শোয়ার্জেনেগার। নিজেকে এমন দাবি করার অধিকার হয়তো শুধু তাঁরই আছে। কারণ বিশ্ববাসীর কাছে এক মহাবিস্ময়ের নাম যে আরনল্ড শোয়ার্জেনেগার!
মীর মুশফিক আহসান
সিবিএস নিউজ, ব্লু প্রিন্ট ভিডিও ডটকম, রাডার অনলাইন
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন